কেউ চোখে দেখে না, কারো চোখে পর্দা পড়ে গেছে, কারো আছে চোখের নেত্রনালীর সমস্যা। হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে এ ধরনের ১০৮ প্রবীণকে চোখের অপারেশন করে দৃষ্টি শক্তি এনে দিলেন একটি বেসরকারি সংস্থা। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই ব্যবস্থাটি করেন দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা নামে বেসরকারি এই সংস্থাটি।
আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল হওয়ায় খরচ বহন করে জেলা সদরে গিয়ে এসব প্রবীনের পক্ষে চোখের চিকিৎসা করা অসম্ভব হয়ে উঠে। এতে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল এসব প্রবীণরা ভিক্ষাবৃত্তিসহ মানবেতর জীবন যাপন করছে।
দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার উদ্যোগে পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে গত দুই বছরে ৪টি ধাপে নিঝুম দ্বীপের ১০৮ জনকে এই সুযোগ করে দেওয়া হয়। সমৃদ্ধি কর্মসূচির স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি কার্যক্রমের আওতায় নিঝুম দ্বীপের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে এদের বাচাই করা হয়।
সবশেষে গত জুলাই মাসে ১৪ জনকে নোয়াখালী জেলা সদর অন্ধকল্যাণ হাসপাতাল থেকে অপারেশন করানো হয়। এখন তারা নিঝুম দ্বীপে নিজেদের বাড়িতে অবস্থান করছেন। সংস্থার নিজস্ব ডাক্তার প্রতি সপ্তাহে গিয়ে তাদের ফলোআপ করছেন।
গত জুলাই মাসে ছানি অপারেশন করে বাড়ি আসা নিঝুম দ্বীপের ২নং ওয়ার্ডের ইসলামপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. মোস্তাফ (৭২) জানান, দুই ছেলেসহ পরিবারের ৬ সদস্যকে নিয়ে তার বসবাস। ছেলেরা নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। গত তিন বছর ধরে সে চোখে তেমন একটা দেখেন না। একবার উপজেলা সদরে প্রাইভেট এক হাসপাতালে গিয়ে চোখ দেখানোর পর তাকে ছানি অপারেশন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থের অভাবে তার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। অনেকটা ঘরবন্দি হয়ে যান। সংবাদ পেয়ে দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরা এসে তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যান। জেলা সদরের একটি হাসপাতালে গত মাসের (জুলাই) শেষের দিকে তার ছানি অপারেশন করানো হয়। এখন তিনি চোখে ভালোভাবে দেখতে পান। প্রতি বৃহস্পতিবার ডাক্তার এসে দেখে যান তাকে।
একই অবস্থা নিঝুম দ্বীপের পূর্বাঞ্চল গ্রামের বাসিন্দা মো. সালা উদ্দিনের (৭৫)। এক সময় বাজারে সবজি বিক্রি করে সংসার চালাতেন। গত তিন বছর চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ভিক্ষা করে চলতো সংসার। পরিবারের তিন ছেলে সবাই পৃথক হয়ে যাওয়ায় সরকারি খালপাড়ে বৃদ্ধ স্ত্রীকে নিয়ে একা বসবাস করেন। নিঝুম দ্বীপে চোখের চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় কখনো ডাক্তার দেখানোর সূযোগ পাননি। নিঝুম দ্বীপ থেকে উপজেলা সদর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো না। তাই প্রয়োজন অনুধাবন করলেও ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি। গত মাসে বাজারে ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেখে গ্রামের একজন তাকে দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থার বন্দর টিলা কার্যালয়ে নিয়ে যায়। তারা তাকে সম্পূর্ণ নিজস্ব খরচে জেলা সদর নিয়ে চোখের অপারেশন করে দিয়েছে। এখন সে আগের মত দেখতে পান। আগামী সপ্তাহ থেকে আগের মত সবজির ব্যবসা শুরু করবেন।
এই কাজের দায়িত্বে থাকা সমৃদ্ধি কর্মসূচীর সমন্বয়কারী মো. নুরন্নবী জানান, নিঝুম দ্বীপে গত চার বছর ধরে তারা স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি নিয়ে কাজ করছেন। এতে বিনামূল্যে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন তাদের নিজস্ব ডাক্তার। এতে দেখা যায় গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অস্বচ্ছল কিছু লোক চোখের ছানি ও নেত্রনালীসহ বিভিন্ন সমস্যায় রয়েছে। এদের কথা চিন্তা করে সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত দুই বছরে এই প্রকল্পের মাধ্যমে চার ধাপে ১০৮ জন নারী, পুরুষ প্রবীণ লোককে চোখের ছানি, নেত্রনালীর অপারেশনের ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিজন রোগীর জন্য জেলা সদরে আসা যাওয়া থাকা ও অপারেশনসহ সংস্থার প্রায় ৭ হাজার টাকা করে খরচ করতে হয়েছে। সংস্থার নিজস্ব লোকজন এদের দেখভাল করছেন। অপারেশন শেষে বাড়ি আসার পর সংস্থার নিজস্ব ডাক্তার প্রতি সপ্তাহে একবার এসে এদের ফলোআপ করছেন।
এ ব্যাপারে নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দিনাজ উদ্দিন বলেন, সাগর পাড়ে অবস্থান নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় এখানে স্বাস্থ্য সেবার তেমন উন্নয়ন হয়নি। জটিল কোনো রোগ দেখা দিলে ৪০ কিলোমিটার অতিক্রম করে যেতে হয় উপজেলা সদরে। দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা অনেক দিন থেকে নিঝুম দ্বীপে কাজ করছে। বিনামূল্যে প্রবীণদের চোখের অপারেশন করে দিচ্ছেন তারা। সংস্থার লোকজনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এই কাজে আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ও তাদেরকে সহযোগীতা করতে আগ্রহী আছি।
হাতিয়ায় ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় প্রায় ৭ লাখ লোকের বসবাস। উপজেলা সদরে ৫০ শয্যার হাসপাতালটি দ্বীপের চিকিৎসা সেবার একমাত্র অবলম্বন। হাতিয়ার চার পাশে নিঝুম দ্বীপসহ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের লোকজনকে জরুরি চিকিৎসা নিতে হলে আসতে হয় এই হাসপাতালে। কিন্তু এই হাসপাতালে চোখের উন্নত চিকিৎসা সেবার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে চোখের সমস্যা নিয়ে আসা রোগীরা ছুটে যান জেলা সদরে। যাতে অতিরিক্ত সময় ও আর্থিক ব্যয় বেশি করতে হয়।